ড. এস এম শাহনূর
উনিশ শ একাত্তরের এই দিনে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শহরে, ধ্বংস্তুপের নগরে উড্ডীন হয়েছে লাল সবুজের পতাকা। যে জনপদের বুক পুড়েছে, মুখ পুড়েছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে মৃত দেহ, কুরুলিয়া নামক খালে বয়ে গেছে অর্ধশতাধিক বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের তাজা রক্তধারা, তিতাসের জলে ভেসেছে হাজারো নিরপরাধ মানুষের লাশ,তার নাম মুক্তিযুদ্ধের তীর্থভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মূলত ৭১ এর মুক্তিযুূ্দ্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমাতে জনযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। এখানকার প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে। প্রাণ দিয়েছে অর্ধ লক্ষাধিক দেশপ্রেমিক বাঙালি। দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের পর মুক্তি সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। মুক্তি পিয়াসীদের আরাধ্য স্বাধীনতার সোনালী সূর্যও পূর্ব দিগন্তে উদিত হতে থাকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে হানাদার মুক্ত করতে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে জেলার আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় মিত্র বাহিনী পাক বাহিনীর উপর বেপরোয়া আক্রমণ চালাতে থাকে। ১ ডিসেম্বর আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধে ২০ হানাদার নিহত হয়। ৩ ডিসেম্বর আখাউড়ার আজমপুরে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এখানে ১১ হানাদার নিহত হয়। শহীদ হন তিন মুক্তিযোদ্ধা। এরই মাঝে বর্তমান বিজয়নগর উপজেলার মেরাশানী, সিঙ্গারবিল, মুকুন্দপুর, হরষপুর, আখাউড়া উপজেলার আজমপুর, রাজাপুর এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ৪ ডিসেম্বর পাক হানাদাররা পিছু হটতে থাকলে আখাউড়া অনেকটাই শত্রুমুক্ত হয়ে পড়ে। এখানে রেলওয়ে স্টেশনের যুদ্ধে পাক বাহিনীর দুই শতাধিক সেনা হতাহত হয়। ৬ ডিসেম্বর আখাউড়া সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়।এরপর থেকে চলতে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করার প্রস্তুতি। মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দক্ষিণ দিক থেকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে এবং মিত্র বাহিনীর ৫৭তম মাউন্টের ডিভিশন আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেললাইন ও উজানীসার সড়ক দিয়ে অগ্রসর হয়ে শহরের চতুর্দিকে অবস্থান নেয়। দুদিন আগেও যাদের প্রতাপে শহরে চলা দায় ছিল, ৬ ডিসেম্বর রাত থেকেই তাদের পালানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
➤কুরুলিয়ার পাড়ে, শিমরাইল কান্দি, সরকারি কলেজের পেছনে বর্তমানে গড়ে উঠা কলেজের নতুন ভবন সমূহের এলাকায়, দাতিয়ারা চাদমারী, পৈরতলা সহ এখানে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় গণকবর!
৭ ডিসেম্বর বিকালের আগেই পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছেড়ে আশুগঞ্জের দিকে পালাতে থাকে।
➤সরাইল হানাদার মুক্ত দিবসও কিন্তু ৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সনের ৭ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আল-বদর, আল-সামস্ ও রাজাকাররা চুন্টা, কালীকচ্ছ ও ধর্মতীর্থ গ্রামের ৪৩ জন এবং শাহবাজপুর তিতাস নদীর দক্ষিণপাড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের শত শত নারী পুরুষকে হত্যা করে। তখন কুচনী গ্রামের ৯ জন হিন্দুকে হত্যা করে পাক বাহিনী। সরাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসীকতায় ও মরণপণ লড়াই করে পাক-হানাদর বাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে শাহবাজপুর,পানিশ্বর, বিটঘর, কুন্ডা, বড়ইবাড়ি, কানিকাই, শান্তিনগর, বেড়তলা ও দূর্গাপুরে লড়াই করে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের উৎখাত করতে সক্ষম হয়। এসময় ১৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় ও ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। সরাইল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে গণকবর ও বদ্ধভূমি।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৮ তারিখ মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে বিনা বাঁধায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করে। এক নতুন প্রভাতের সূচনা হয়। সকালে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী শহরের পুরাতন কাচারী ভবন সংলগ্ন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রুমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেন।ঐ দিন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে মুখে ছিল বিজয়ের এক অনাবিল আনন্দধারা।
লেখক: ড. এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।
Copyright © 2024 Daily Frontier News | Design & Developed By: ZamZam Graphics