ড. এস এম শাহনূর
৭১ এর ২৫ মার্চ। রাতের আঁধারে নির্বিচারে মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানী হায়েনারা। হত্যা করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও নিরীহ বাঙালিদের।
শুরু হয় প্রতিরোধ। দৃঢ় হতে থাকে বাঙলার মুক্তিকামী মানুষের প্রতিঘাতের ভাষা। পরিকল্পিত যুদ্ধের জন্য সারাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ২ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। যদিও ২২ অক্টোবর থেকে এই সেক্টরের দায়িত্ব বুঝে নেন মেজর এ টি এম হায়দার।
ঢাকা শহর ও জেলার দক্ষিণাংশ, আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেললাইনের উত্তরাংশ বাদে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা, ফরিদপুর জেলার পূর্বাংশ এবং মুহুরী নদীর পূর্বাংশ বাদে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে ছিলো সেক্টর ২। এই সেক্টরের অধীনে ছয়টি সাব সেক্টর থেকেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ পরিচালিত হয়। সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাব ১৬৯টি যুদ্ধের তথ্য মেলে ২ নম্বর সেক্টরে। ‘এই সেক্টরের মাধ্যমে মোট ২২৬টি অপারেশন হয়।’ [৬] এর মধ্যে ছিলো গেরিলা হামলাও। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। বাঙালি পায় মুক্তির স্বাদ। তবে এই লড়াইয়ে প্রাণ দিতে হয় ত্রিশ লাখ মানুষকে। সম্ভ্রম হারান দুই লাখ নারী। এই আত্মদানকারীদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত ২ নং সেক্টরের অন্যতম রণাঙ্গন ও অসংখ্য জ্ঞানীগুণী মানুষের জন্মস্থান ঐতিহ্যবাহি জনপদ কসবা। শত শহীদের রক্তে স্নাত কসবার মাটি। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিশাল গড় থানার পশ্চিমে সীমান্তবর্তী সবুজ গাছপালার গ্রাম, পাহাড়ি টিলার সবুজ বনানী, সমতল শস্যদেবী কসবা উপজেলা। শীর্ণকায় স্রোতধারার সালদা, সিনাই, বিজনা, সাঙ্গুর, বুড়ি, কালিয়ারা, তিতাস নদী এঁকেবেকে কসবাকে সমৃদ্ধ করেছে ।প্রাচীন জনপদ কসবার জনগণের স্বাধীনতার স্পৃহা বহমান আবহমান ত্রিপুরা রাজ্যের জন্মলগ্ন থেকে। ‘ব্রিটিশ ভারতে ত্রিপুরা ও পার্বত্য ত্রিপুরা একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। ত্রিপুরার মহারাজা শ্রী শ্রী বীরবিক্রম কিরীট কিশোর মাণিক্যবাহাদুর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যকে পাশ কাটিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের স্বকীয়তা বজায় রেখে ত্রিপুরার জনগণের স্বাধীনচেতা মনোভাব অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। তাই এ এলাকার জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা আবহমান কাল থেকে। কসবার আপামর জনতা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ- এর প্রতিটি পর্বে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে।১৪ এপ্রিল, ১৯৭১, পহেলা বৈশাখ বুধবার দুপুর ১২টায় পাকিস্তানি বাহিনী ধাবিত হয় কসবার দিকে। তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেও প্রতিরোধ বূহ্য ভেঙে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর কসবায় প্রবেশ করে ও বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয়। ১৪ এপ্রিল থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত কসবা সদরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানকালে একটি দিনও তারা কসবা এলাকায় নিরাপদে অবস্থান করতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিনিয়ত তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর অবশেষে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও বিচক্ষণতায় একটি মরণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে কসবা সদর ২২ অক্টোবর শত্রুমুক্ত হয়। এর পর কোনোদিন পাকিস্তানি বাহিনী কসবা সদরে প্রবেশ করতে পারেনি’। [৩]
এ থানায় প্রায় ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন। অন্য দিকে আহত হন ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। কসবা থানায় পাকসেনাদের সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে দেশের বহু মুক্তিযুদ্ধা শহীদ হন।
কসবায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীর উত্তম খেতাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত ছয় জন রয়েছে ।
কুল্লাপাথর, লক্ষীপুর, আকাবপুর, শ্যামপুর, পুটিয়া, চারগাছ, জমশেরপুর শিমরাইল প্রভৃতি ছোট বড় আটটি স্থানে সমাধিস্থল রয়েছে। খন্ড খন্ড শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সমূহকে একত্রিত করে কোল্লাপাথর অথবা লক্ষীপুর শহীদ সমাধীস্থলে স্থানান্তর করা যেতে পারে।
কসবা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ২নং সেক্টরের আওতাভুক্ত ছিল। ২নং সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন খালেদ মোশারফ। কোল্লাপাথর, খাদলা, মাদলা, বেলতলীসহ বহু গ্রাম ছিল মুক্তাঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ বিচরণ ছিল এ সমস্ত গ্রামসমূহে। খালেদ মোশারফের একান্ত ইচ্ছা ছিল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাংলাদেশের ভূখন্ডে একটি পৃথক সমাধিস্থল গড়ে তোলা। সালদানদী সাব সেক্টরে তখন তুমুল যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন হাবিলদার তৈয়ব আলী। যুদ্ধ শেষে সাব সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার সহযোদ্ধার মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা করিমের পিতা মরহুম আ: মান্নান দান করলেন ৬৫ শতক ভূখন্ড। সীমান্ত ঘেঁষা বায়েক ইউনিয়নের কুল্লাপাথর।এ গ্রামেই ঘুমিয়ে আছে বাঙালি জাতির অহংকার ৪৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কোল্লাপাথরে যে ৫০ জন শহীদ ঘুমিয়ে আছেন তাদের প্রায় সকলেই দুই নম্বর সেক্টরের তিনটি সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করে শহীদ হন। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের মতে এখানে আরো বেশী শহীদদেরকে কবরস্থ করা হয় বলে প্রতীয়মান। “কোল্লাপাথর সমাধিস্থল ছাড়াও আশেপাশে ১ হাজার ১৫৫জন শহীদের কবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।”[৬] যুদ্ধে বহু শহীদকে এখানে সমাধিস্থল করা হয়। গড়ে উঠে মুক্তি সংগ্রামের অমূল্য স্মৃতি কোল্লাপাথর সমাধিস্থল।
৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে দুইজন বীর উত্তম, দুইজন বীরপ্রতীক এবং একজন বীর বিক্রম উপাধি পাওয়া যোদ্ধার সমাধি রয়েছে।হাবিলদার তৈয়ব আলী হচ্ছেন প্রথম শহীদ, যাকে সর্ব প্রথম কোল্লাপাথরের সমাধিতে সমাহিত করা হয়। কোল্লাপাথর সমাধিস্থলে ঘুমিয়ে থাকা নায়েক সুবেদার মইনুল ইসলামের নামে ঢাকা সেনানিবাস এলাকার অতি পরিচিত মইনুল সড়কের নামকরণ হয়েছে। এখানে ৫০ জনের মধ্যে তিনজন অজ্ঞাত বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে।
এখানে যাঁদেরকে সমাধিস্থ করা হয় সেই সকল বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন-
(১) সিপাহী দর্শন আলী, (২) মো: জাকির হোসেন
(৩) আবদুল জব্বার, (৪) হাবিলদার তৈয়ব আলী,
(৫) নায়েক আবদুস সাত্তার, (৬) সিপাহী আব্বাস আলী, (৭) মো: ফারুক আহাম্মদ, (৮) মো: ফখরুল আলম, (৯) মোজাহদী নূর মিয়া, (১০) নায়েক মোজাম্মেল হক, (১১) নায়েব সুবেদার মো: আবদুর সালাম, (১২) নোয়াব আলী, (১৩) সিপাহী মোসলেম মৃধা, (১৪) প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, (১৫) মো: আবদুল ওদুদ, (১৬) সিপাহী আজিম উদ্দিন, (১৭) মতিউর রহমান, (১৮) মোশারফ হোসেন,
(১৯) নায়েব সুবেদার মাইনুল ইসলাম, (২০) সিপাহী নূরুল হক, (২১) মো: আবদুল কাইয়ুম, (২২) সিপাহী হুমায়ুন কবির,(২৩) ল্যান্স নায়েক মো: আবদুল খালেক, (২৪) ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান,
(২৫) মো: তারু মিয়া, (২৬) নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন, (২৭) মো: রফিকুল ইসলাম, (২৮) মো: মোরশেদ মিয়া, (২৯) শ্রী আশোতোষ রঞ্জন দে, (৩০) মো: তাজুল ইসলাম, (৩১) মো: শওকত, (৩২) মো: আবদুস সালাম সরকার,(৩৩) মো: জাহাঙ্গীর, (৩৪) আমীর হোসেন,
(৩৫) শ্রী পরেশ চন্দ্র মল্লিক, (৩৬) মো: জামাল উদ্দিন, (৩৭) মো: আবদুল আওয়াল, (৩৮) মো: আবেদ আহাম্মেদ, (৩৯) মো: সিরাজুল ইসলাম, (৪০) মো: ফরিদ মিয়া, (৪১) মো: মতিউর রহমান, (৪২) মো: সাকিব মিয়া, (৪৩) মো: আবদুর রশীদ, (৪৪) আনসার এলাহী বক্স, (৪৫) সিপাহী শাহিদুল হক, (৪৬) সিপাহী আনোয়ার হোসেন, (৪৭) মো: আবদুল বারী, (৪৮) অজ্ঞাত ও (৪৯) অজ্ঞাত।
‘কুমিল্লার গৌরব তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে-
(১) মোজাম্মেল হক আবু,
(২) আবু জাহিদ আবু ও
(৩) সাইফুল ইসলাম সাফু।এই তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গন ও মৃত্যুস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের চারগাছ বাজারের সন্নিকট এবং তাঁদের শেষ আশ্রয় স্থল বা কবর একই উপজেলার বাদৈর ইউনিয়নের জমশেরপুরে। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর শহীদ মোজাম্মেল হক আবুর পরিবারের মাধ্যমে কবরগুলো পাকারণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।’ [৫]
সীমান্তের পাশে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের লক্ষীপুর শহীদ সমাধিস্থলে ১২ জন বীর শহীদের কবর রয়েছে।
২ নম্বর সেক্টরের প্রধান খালেদ মোশারফের নির্দেশে এই সমাধি ক্ষেত্রটি গড়ে উঠে। তৎকালীন সাব সেক্টর কমান্ডার আইন উদ্দিন, গ্রুপ কমান্ডার নাজির হোসেনের নেতৃত্বে লতুয়ামুড়া, চন্ডিদ্বার, কসবা, বগাবাড়ী, আকবপুর ইত্যাদি এর মধ্যে বগাবাড়ীর আব্দুল ওহাব মিয়ার বাড়িতে মুক্তিবাহিনী ব্যাংকার করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করার কথা জানা যায়। এ সমস্ত এলাকায় সম্মুখ সমরে যারা শহীদ হয়ে ছিলেন তাদেরকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছে।
➤২১ নভেম্বর কসবা থানার চন্দ্রপুর যুদ্ধে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।লক্ষীপুরে তাদেরকে কবর দেওয়া হয়।
এ সমাধিস্থলে ঘুমিয়েআছেন-
(১) লেফটেন্যান্ট আজিজুল হক, (২) সুবেদার আবুল হোসেন,
(৩) হাবিলদার আবদুল হাকিম, (৪) হাবিলদার আবুল কাসেম,
(৫) নায়েক আবুল কালেম, (৬) ল্যান্স নায়েক নূরুল হক,
(৭) সিপাহী আবেদ আলী, (৮) সিপাহী এনামুল হক, (৯) সিপাহী আবুল কাসেম, (১০) সিপাহী বুরহান উদ্দীন,
(১১) সিপাহী রফিকুল ইসলাম, (১২) সিপাহী আবদুর রাজ্জাক।
সকল শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
তথ্যঋণ:
[১] মুক্তিযুদ্ধে কসবা।। ড. সুকুমার বিশ্বাস সম্পাদিত
[২] মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স
লেখক: খালেদ মোশাররফ
প্রকাশনী: প্রথমা প্রকাশন
[৩] মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন।। মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত
[৪] মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া।। জয়দুল হোসেন
[৫] চারগাছ রণাঙ্গনের ৩ শহীদের সমাধি জমশেরপুর।।এস এম শাহনূর
| ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ | আওয়ার কণ্ঠ ২৪.কম
[৬] মুক্তিযুদ্ধের ৫০ শহীদের সমাধিস্থল কোল্লা পাথর
ঢাকা টাইমস,
১৭ ডিসেম্বর, ২০২০
লেখক: আন্তর্জাতিক কবি ও গবেষক।
Copyright © 2024 Daily Frontier News | Design & Developed By: ZamZam Graphics