Daily Frontier News
Daily Frontier News

মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বিজয়নগরের মুকুন্দপুর মুক্ত দিবসের কথকতা

 

ড. এস এম শাহনূর

 

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর বিজয়নগর উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামে তুমুল এক যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত হয় এই এলাকা। যুদ্ধে ১৯ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ১৮ রাজপুত ব্যাটালিয়নের সদস্যরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে দিনব্যাপি যুদ্ধের পর মুকুন্দপুর স্টেশন ও মুকুন্দপুর গ্রাম পাক হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়। কেমন ছিল সে দিন? বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.)আবু সালেহ মুহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রমের লেখা Bangladesh Fights For Independence গ্রন্থে যুদ্ধকালীন সময়ের বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য উঠে এসেছে। জানা যায়, যুদ্ধ চলাকালীন সিলেটের সাথে যোগাযোগের ও সরবরাহ লাইনের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পয়েন্ট মুকুন্দপুর রেল স্টেশন ও তৎসংলগ্ন গ্রাম পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে এস ফোর্সের অন্তর্গত ২ ইবিআর রেজিমেন্ট সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। মিত্রবাহিনীর ১৮ রাজপুত ব্যাটালিয়ানের সহায়তা নিয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায় মুক্তি বাহিনী। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যার মধ্যেই ১৮ রাজপুত ব্যাট. জলিলপুরে রেল লাইন ব্লক করে দেয়। ২ বেংগলের একটি অংশ কালনিছড়া নদীর দক্ষিণে অবস্থান নেয়। অবশিষ্ট ২ বেংগল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সায়ীদের (পরে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মুকুন্দপুরে অনুপ্রবেশ করে পূর্বনির্ধারিত FUP অর্থাৎ মিলনস্থল মুকুন্দপুর এর পূর্বপ্রান্তে আক্রমন স্থলের ৫০০গজ দূরে সম্মিলিত হয়। শেষ রাতে আক্রমন রচনা করে পাকবাহিনীর তীব্র প্রতিরোধ গুড়িয়ে ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় সম্পূর্ণ দখল মুক্ত হয় মুকুন্দপুর। মুকুন্দপুর যুদ্ধে ৩১ জন পাক সেনাসদস্য, ২টি এলএমজি,২৯টি রাইফেল ২টি স্টেনগান, ও ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং বিপুল পরিমান গোলাবারুদ ও রসদ মুক্তিবাহিনী আটক করে। অপর দিকে সঠিক পরিকল্পনার কারণে সেদিনের অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ছিল বড়ই নগন্য।

➤মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের মুকুন্দপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ বীর প্রতীক, বিপি (অব.) (তৎকালীন লে.) থেকে ঐতিহাসিক মুকুন্দপুর মুক্ত দিবসের পেছনে ছায়েরা বেগম নামে এক দুঃসাহসী নারীর অনন্য ভূমিকার কথা জানা যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার ‘জনযুদ্ধে গণযোদ্ধা’ গ্রন্থেও এই সাহসিনীর সাহসিকতার গল্প বিধৃত হয়েছে। বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী সেজামোড়া গ্রামের আজিজ চৌকিদারের ডানপিটে মেয়ে ছায়েরা বেগম। একাত্তরে ছায়েরা বেগম ১৫-১৬ বছরের কিশোরী। বাবা আজিজ চৌকিদার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাঙ্কার খননসহ টুকটাক কাজে হানাদারদের ক্যাম্পে যেতে হতো। একসময় তাকেও বাধ্য হয়ে ক্যাম্পে যেতে হয়। অমানবিক নির্যাতন থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় প্রতিশোধের স্পৃহা। কৌশলে গল্পের ছলে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডার থেকে জেনে নিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে করা অপারেশনের দিনক্ষণ। জানিয়ে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।তাঁর খবরাখবরের ভিত্তিতে একাধিক অপারেশনে সফল হয় মুক্তিবাহিনী। একদিন মেজর জেনারেল (অব.) সায়ীদ আহমেদ-কে গোয়ালনগর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান, বাংকার,গোলাবারুদ রাখার স্থানের তথ্য জানিয়ে ছিলেন ছায়েরা বেগম। এ তথ্যের ভিত্তিতেই ১৮ ও ১৯ নভেম্বর যুদ্ধ করে মুকুন্দপুর হানাদারমুক্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। মেজর জেনারেল (অব.) সায়ীদ আহমেদ এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালের মার্চে জেলা প্রশাসনের জারিকৃত পত্রের ভিত্তিতে জুলাই থেকে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ছায়েরা বেগম। আবার মুক্তিযুদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার বলে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে তাঁর ভাতা বন্ধ রয়েছে। পরিতাপের বিষয় বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছায়েরা বেগমের মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা দুই বছর ধরে বন্ধ থাকার সংবাদ সত্যিই দুঃখজনক।

সম্মুখ সমরে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ না হলেও এসকল অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এক পরম আরাধ্য ফলাফল স্বাধীন বাংলদেশ।

➤তথ্য ঋণ:
[১] সালেহ মুহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রমের লেখা Bangladesh Fights For Independence
[২] বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার ‘জনযুদ্ধে গণযোদ্ধা’
[৩] ছায়েরার দেওয়া তথ্যেই মুক্ত হয় মুকুন্দপুর।
দৈনিক সমকাল (অপরাজিতা)
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২১ ।
[৪] বিজয়নগরে মুকুন্দপুর মুক্ত দিবস পালিত।
যায়যায়দিন। প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২১,

লেখক: ড. এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।

Daily Frontier News