শিবলী সাদিক খানঃ-
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) মেয়র কাউন্সিলরদের অপসারণের পাশাপাশি অনেক ঠিকাদার গা ঢাকা দেওয়ায় উন্নয়ন কাজে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। দুভোর্গের মধ্যে বাতিল করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার কাজ। সাধারণ মানুষের দুভোর্গ লাঘবে সরকারের পাশে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে নিজেদের পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন ফ্যাসিস্ট বিরোধী কাউন্সিলররা।
২০১৮ সালে দেশের সর্বশেষ ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন গঠিত হলেও তেমন উন্নয়ণের ছোঁয়া লাগেনি। এলাকার মানুষের চাহিদা বিবেচনায় সরকার ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর বিশেষ প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ‘ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন সড়ক উন্নয়ন ও ড্রেনেজ নেটওয়ার্কসহ নাগরিক সেবা উন্নতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয় ১ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪৭৫ কিলোমিটার সড়ক, ৩৪৫ কিলোমিটার নালা (ড্রেন), প্রায় ১৭ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ, ৩৭ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল, ১ দশমিক ১০ কিলোমিটার সড়ক বিভাজক, ৩টি সেতু, ১৩টি কালভার্ট ও ৬টি পদচারী—সেতু নির্মাণের কথা।
গত ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ হয়েছে মাত্র ৪৫ শতাংশ। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের পর চলমান বিভিন্ন সড়ক ও ড্রেনের নির্মাণকাজ ফেলে ঠিকাদার লাপাত্তা হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে ৮টি প্যাকেজে প্রায় শতকোটি টাকার কাজ। এতে ভোগান্তি বেড়েছে সাধারণ জনগণের। শুধু রাস্তা—ঘাট ড্রেনেজ ব্যবস্থায় ভোগান্তি নয়, মেয়র কাউন্সিলরদের অপসারণ করে প্রশাসনিক কর্মকতার্দের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ায় বিভিন্ন সনদ পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনগণকে। তবে প্রশাসনিক দায়িত্বরত কর্মকতার্রা বলছেন, মানুষের সাময়িক কিছুটা ভোগান্তি হলেও তা নিরসনে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নগরীর কেওয়াটখালি ১৯ ও ২০ ওয়ার্ডের সড়ক ও ড্রেনের উন্নয়ন কাজ শুরু হয়। ছয় মাস না যেতেই বন্ধ হয়ে যায় সেই কাজ। এতে প্রায় তিন বছর ধরে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। শুধু কেওয়াটখালী নয়, নগরের ভাটিকাশর, বলাশপুর, গোহাইলকান্দি, নতুনবাজার সড়কে একই অবস্থা। সড়কের ভাঙাচোরার কারণে যানবাহন না চলায় সময়মতো স্কুল কলেজে পৌঁছাতে পারছেন শিক্ষার্থীরা।
বলাশপুর এলাকার বাসিন্দা হুমায়ূন কবীর বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কারিতাসের মোড় পর্যন্ত রাস্তাটি তিন বছর ধরে ভাঙাচোরা অবস্থা। এই এক কিলোমিটার রাস্তা ও ড্রেন অসম্পন্ন থাকায় আমাদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। বষার্কাল আসলেই পানি বাসা বাড়িতে ওঠে, আর এখন কোন গাড়ি চলাচল করে না। এর সাথের অনেক রাস্তার নিমার্ণ সম্পন্ন হলেও আমরা ভোগান্তির মধ্যে পড়েছি।
স্থানীয় দোকানী শফিকুল ইসলাম বলেন, ভাটিকাশর আলিয়া মাদ্রাসা রোড হতে বিনার বাড়ি পর্যন্ত আরসিসি এই রাস্তাটির নিমার্ণ ব্যয় ধরা হয় ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। কিন্তু কাজ শুরু হলেও আবার কয়েক দফা বন্ধ হয়। সবশেষ ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা কোন ঠিকাদার আসতে দেখি নাই। শুনেছি ঠিকাদার লাপাত্তা হয়ে গেছে। এরমধ্যে কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমরা তো ভোগান্তিতেই রয়েছি। আমাদের কষ্টের কথা এখন বলার মতও কাউকে পাচ্ছি না। অন্তত কাউন্সিলরা তারা তাদের দায়িত্বে থাকলে আমরা কিছুটা হলেও সহযোগিতা পেতাম।
নতুন বাজার এলাকার কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী রাইসুল হাসান বলেন, দুই বছর ভোগান্তির পর অবশেষে কয়েকদিন হল শুরু হয়েছে নতুন বাজার রাস্তার কাজ। কিন্তু যে মানের কাজ হচ্ছে, খুব বেশিদিন টেকসই হবে না। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের গাফিলতি রয়েছে। আমরা নগরবাসী নাগরিক সেবা নিশ্চিত হোক সেটাই প্রত্যাশা করি।
গোহাইলকান্দি এলাকার মানসুর আহম্মেদ বলেন, ৫ আগস্টের আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে গন্দ্রপা থেকে গোহাইলকান্দি প্রাইমারী স্কুল মোড় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা ও ড্রেন নিমার্ণের কাজ। আগে ড্রেন নিমার্ণ কাজ সম্পন্ন হলে পরে নিমার্ণ হবে রাস্তা। কিন্তু কোনটাই হচ্ছে না, যার কারণে এই এলাকার শতশত মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
নওমহল এলাকার বাসিন্দা মো.সেলিম বলেন, কাউন্সিলরদের অপসারণ করায় আমাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে জন্ম, মৃত্যু এবং ওয়ারিশান সনদ পেতে। এখন সমস্ত কাগজ—পত্র কাউন্সিলর অফিসের কম্পিউটার ম্যানের কাছে রেখে গেলে সে দায়িত্বরত কাউন্সিলরের কাছে কয়েকদিন ঘুরে স্বাক্ষর আনলে পরে আমরা জন্ম, মৃত্যু সনদ পাই। এভাবে আসলে চলতে পারে না। অন্তত ফ্যাসিস্ট বিরোধী কাউন্সিলর যারা রয়েছেন তাদের পুনর্বহাল করা প্রয়োজন।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ১০,১১ এবং ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সংরক্ষিত কাউন্সিলর রোকসানা শিরিন বলেন, আমার দুই মেয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে জোড়ালো ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু দেখা গেল সরকার পতনের পর সিটি করপোরেশন থেকে আমাদের অপসারণ করা হয়েছে। এতে মানুষ অনেক দুভোর্গে রয়েছে, আমরাও খুব বেশি তাদের জন্য করতে পারছি না। আমরা চাই অন্তবতীর্কালীন সরকার তাঁর হাতকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি মানুষের দুভোর্গ লাঘবে আমাদের পুনর্বহাল করবে।
ফরিদপুর জান্নাত কনস্ট্রাকশনের ইঞ্জিনিয়ার মো.নাজমুল হক বলেন, নানা কারণে দীর্ঘদিন নতুন বাজারের কাজটি সম্পন্ন করতে পারি নাই। বিগত কয়েকদিন ধরে আবার কাজ শুরু করা হয়েছে, আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যে তা শেষ হবে। এছাড়া অন্যান্য রাস্তা ও ড্রেনের কাজগুলো দ্রুত শেষ করার তাগিদ রয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, ময়মনসিংহ একটি অপরিকল্পিত নগরী। এখানে মানুষজন নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে বসবাস করে আসছে। কেউ দায়িত্ব নিয়ে সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে এগিয়ে আসেনি। বিগত সময়ে উন্নয়নের নামে লুটপাট হয়েছে বেশি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মেয়র কাউন্সিলরদের অপসারণ করার পাশাপাশি ঠিকাদার লাপাত্তা হওয়ায় ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। আমরা চাই অসম্পন্ন কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হোক।
ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি ড.আশরাফুর রহমান বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর যখন মানুষের সেবাখাতটি জনপ্রতিনিধি শূণ্য হয়ে গেল তখন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং অন্যান্য স্থানে প্রশাসনকে জড়িত করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের আমাদের পুলিশের একজন কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করছে। এতে করে পুলিশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশও দায়িত্বের বাহিরে গিয়ে সেবামূলক কাজ অব্যাহত রেখেছে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নিবার্হী সুমনা আল মজীদ বলেন, চলমান ৮৬টি প্যাকেজের মধ্যে ঠিকাদারের অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে ৮টি প্যাকেজ বাতিল করা হয়েছে। এতে টাকার পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। চলমান কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে, আর সেই লক্ষ্যে কাজগুলো যথাসময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য তাগিদ দেয়া হচ্ছে। আশা রাখছি সকলের সহযোগিতায় কাজগুলো সম্পন্ন হলে মানুষের ভোগান্তি নিরসন হবে।
ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোখতার আহমেদ বলেন, সংকটের মধ্যে মানুষের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সিটি করপোরেশনের মধ্যে চলমান কাজ সম্পন্ন করার জন্যে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে।
Copyright © 2025 Daily Frontier News | Design & Developed By: ZamZam Graphics