দলিল উদ্দিন গাজীপুর
গাজীপুরে যে সড়কের ১২ কিলোমিটারে ছিনতাই–আতঙ্ক
ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের ১১টি ছিনতাই স্পট বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার কথা জানা গেছে।
ছিনতাই বা বিপদ এড়াতে রাতে কারখানা ছুটির পর শ্রমিকেরা দল বেঁধে হাঁটেন।
আড়াই মাসের শিশুসন্তানকে দেখে বরিশাল থেকে কর্মস্থলে ফিরছিলেন নয়ন মৃধা (৩৬)। গাজীপুরের টঙ্গীতে মার্স স্টিচ লিমিটেড নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানার অফিস সহকারী ছিলেন তিনি। গত ১০ জানুয়ারি ভোর পৌনে পাঁচটায় টঙ্গী পৌঁছান নয়ন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের হোসেন মার্কেট এলাকায় বাস থেকে নেমেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। মুঠোফোন ও নগদ টাকার সঙ্গে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন তিনি।
এ ঘটনায় নয়ন মৃধার চাচাতো ভাই ছিদ্দিকুর রহমান বাদী হয়ে ওই দিনই টঙ্গী পশ্চিম থানায় হত্যা মামলা করেন। তিনি জানান, নয়ন যেখানে বাস থেকে নেমেছিলেন, জায়গাটি ছিল নির্জন, অন্ধকারাচ্ছন্ন। এর মধ্যেই একটি মোটরসাইকেলে এসে দুই ছিনতাইকারী তাঁর ব্যাগ, মুঠোফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা নয়নকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান নয়ন।
ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘নয়ন মৃধারা দুই ভাই। নয়নই বড়। তাঁর তিন ছেলে। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবার এখন পথে বসার দশা।’
এক বছরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৪ জন।
শুধু নয়ন মৃধা নন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছিনতাইয়ের এমন ঘটনা। কখনো রাতের অন্ধকারে পথ আটকে, কখনোবা থেমে থাকা বাসের জানালা দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে যাত্রী-পথচারীদের মূল্যবান জিনিসপত্র। কেউ বাধা দিলে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হওয়াসহ প্রাণ হারাতে হচ্ছে অনেককে।
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে শারীরিক জখম নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই ছিনতাইয়ের শিকার। গত এক বছরে ছিনতাইকারীর হামলায় আহত হয়েছেন এমন রোগী পেয়েছি ৯৪ জন। এসব রোগীরা আসেন রাতে।’
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য আছে, এটা সত্য। এর বড় কারণ টঙ্গী এলাকার বিভিন্ন বস্তি। এসব বস্তির কারণে ছিনতাইকারীর সংখ্যাটা বেশি।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম
সড়কটি ঘিরে রয়েছে গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পূর্ব, পশ্চিম, গাছা, বাসন ও সদর থানা। গত এক বছরে এসব থানা এলাকায় কয়টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বা অভিযোগ পড়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি পুলিশ। তবে থানার ডিউটি অফিসাররা জানান, প্রতি মাসে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঘটা ছয় থেকে সাতটি ছিনতাইয়ের লিখিত অভিযোগ পান তাঁরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়ে টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানায়।
১১ ছিনতাই স্পট
দুই সপ্তাহ ধরে সড়কটি ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ১১টি ছিনতাই স্পট বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার কথা জানা গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো আবদুল্লাহপুর বেইলি সেতুর দক্ষিণপাড়, সান্দারপাড়া রাস্তার মাথা, হোন্ডা গলি, শহীদ আহসান উল্লা মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের পেছনে, মিলগেট, ন্যাশনাল টিউবস রোডের মাথা, সফিউদ্দিন রোডের মাথা, হোসেন মার্কেটের কাঠপট্টি, গাজীপুরা বাঁশপট্টি, তারগাছ ও চান্দনা চৌরাস্তায় ময়মনসিংহ বাস কাউন্টার এলাকা।
কখনো রাতের অন্ধকারে পথ আটকে, কখনোবা থেমে থাকা বাসের জানালা দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে যাত্রী-পথচারীদের মূল্যবান জিনিসপত্র। কেউ বাধা দিলে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হওয়াসহ প্রাণ হারাতে হচ্ছে অনেককে।
বাসিন্দারা জানান, সন্ধ্যার পরপরই এসব এলাকায় ঘোরাঘুরি করে অল্প বয়সী কিছু ছেলে। গভীর রাতে কাউকে সড়কে একা পেলে চাকুর ভয় দেখিয়ে বা যানজটে বাসের জানালায় থাবা দিয়ে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। এ সময় কেউ বাধা দিলেই ছুরিকাঘাত করে আহত করে তারা।
টঙ্গী বাজার এলাকায় সেনাকল্যাণ ভবনসংলগ্ন এনভায়রো ফিলিং স্টেশনে কাজ করেন মো. তুহিন। তিনি বলেন, ‘ছয় মাস আগে রাত একটার দিকে হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের স্টেশনে এসে কাঁদতে থাকেন। তাঁর হাত, পা কাটা, রক্ত ঝরছিল। পরে আমার কাছে থাকা একটি ব্যান্ডেজ দিয়ে তাঁর হাত-পা বেঁধে দিই। মাঝেমধ্যেই আমরা এমন ঘটনা পাই।’
Copyright © 2025 Daily Frontier News | Design & Developed By: ZamZam Graphics