ড. এস এম শাহনূর
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বুক চিরে রেল ক্রসিং থেকে কুমারশীলের মোড় পর্যন্ত উত্তর দক্ষিণমুখী প্রধান রাস্তাটির নাম কিন্তু টি, এ রোড। কখনো কী কারোর ইচ্ছে জাগেনি রাস্তার নামকরণে এমন সংক্ষিপ্ত লেটার ব্যবহৃত হওয়ার কারণ? হয়তো ইচ্ছে জাগেনি,হয়তো কেউ জানতে চেয়েছে, হয়তো কারো কাছে সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। আজ আপনাদের-কে সেই তথ্যই জানাব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাসিন্দারা নিশ্চয়ই মডের গোড়ার নাম শুনেছেন। পৌর শহরের প্রধান রাস্তা টি, এ রোড নামকরণের কারণ জানতে হলে আগে মডের গোড়ার প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে।যে জায়গাকে মডের গোড়া বলা হয়, আদতে তা মডের গোড়া নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মডের গোড়া বলে কোনো জায়গা নেই।
এটি তোফায়েল-আজম চত্বর। অতীতের এক গর্বিত ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য মনুমেন্ট।তোফায়েল-আজম চত্বরের অবস্থান কোথায়? ফকিরাপুল ব্রিজের অবস্থান কে না জানে? এই ব্রিজের উত্তরে চলুন,পৌর পুকুর তথা পুরাতন কাচারি পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে চলুন, আরও সহজে বলি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান ডাকঘরের সন্মুখে চলুন দেখবেন সেখানে অনাদর আর অবহেলায় কালের সাক্ষী হয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। এটির নামই মেজর তোফায়েল-জমাদার আজম স্মৃতিস্তম্ভ। অটো আর রিক্সা চালকদের নিকট এবং স্থানীয়ভাবে তা মঠের গোড়া নামেই পরিচিত।
এই স্মৃতিস্তম্ভে শ্বেত পাথরের ওপর “Lucky are those who die so that others may live with honour and dignity” একটি কোটেশন রয়েছে। এই স্তম্ভের পেছনে রয়েছে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টের ৭ তারিখ এক দুঃসাহসিক অভিযানের স্মৃতিকথা।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নির্ধারিত হয় সীমানা। প্রতিষ্ঠিত হয় সার্বভৌমত্ব। ভারতের আগরতলা রাজ্যের সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন পূর্ব-পাকিস্তানের একটি মহকুমা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মুকুন্দপুর রেলওয়ে স্টেশন কে না চিনে?। স্টেশনের পূর্বে একটি বড় গ্রামের নাম লক্ষীপুর। বর্তমানে এটি উক্ত উপজেলার ১০ নং পাহাড়পুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত।
‘৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এটির অবস্থান পূর্ব পাকিস্তানে পড়ে। তা সত্বেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বল প্রয়োগে এটি দখলে নেয়। দীর্ঘদিন তা অপদখল করে রাখে। এ নিয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস ও ভারতীয় বি.এস.এফ’র মধ্যে একাধিক পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও ভারতীয় বাহিনী কোনো অবস্থাতেই লক্ষীপুর গ্রামটির দখল ছাড়তে নারাজ। এতে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্-এর জোয়ানদের মাঝে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। উপায়ন্ত না দেখে মেজর তোফায়েল মোহাম্মদ নিজ দেশের পবিত্র ভূখণ্ড লক্ষীপুর গ্রামকে উদ্ধার করতে এক দুঃসাহসিক অভিযানের পরিকল্পনা করেন।
যেহেতু ভারতীয় বাহিনী শক্তিশালী ও সংখ্যায় অধিক, তাই তিনি আকষ্মিক আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনার দিন শেষ রাতে মাত্র ২৬ জন সৈন্য নিয়ে মেজর তোয়ায়েল মোহাম্মদ এর নেতৃত্বে দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। ভারতীয়দের বুলেট শেষ হয়ে গেলে এরা বেলচা ও গাঁইতি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ইপিআর জোয়ানদের ক্ষতবিক্ষত করে। এ সময় তোফায়েল ও আজম গ্রেনেড মেরে ভারতীয় ক্যাম্প উড়িয়ে দেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাবিলদার প্রিয়লাল শীল ও জমাদার সমশের সিং নিহত হয়, আটক হন কমান্ডেন্ট ঋষিকেষ দেববর্মন (ভৃগু ঠাকুর)।
বিএসএফের অধিনায়ক বিগ্রেডিয়ার ঋষিকেষ দেববর্মন (ভৃগু ঠাকুর)-কে জীবিত অবস্থায় ধরে নিয়ে আসার সময় ভারতীয় বাহিনীর শিকার হয়ে জমাদার আজম ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং মেজর তোফায়েল মোহাম্মদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হলেও তিনি ভিক্ষু ঠাকুরকে ছেড়ে দেননি। এ অবস্থায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভারতীয় জোয়ানরা লক্ষীপুর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান এবং প্রভাত হতেই লক্ষীপুর গ্রামটি ভারতীয় দখলমুক্ত হয়।
কিন্তু মেজর তোফায়েল মোহাম্মদ-এর উরু থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে কুমিল্লা নেয়ার সময় চিকিৎসা দেয়ার পূর্বে পথিমধ্যে শহীদ হন। পরে তাদেরকে আখাউড়ার দেবগ্রামে ইপিআর ক্যাম্পের সন্নিকটে সমাহিত করা হয়। কবরের ওপর লাগানো হয় শ্বেতপাথরের নামফলক। আজ হয়তো কেউ খুঁজে পাবেনা,তবে এই নামফলকের বিস্মৃত শেষ চিহ্ন বিশ/একুশ বছর আগেও দৃশ্যমান ছিল বলে জানিয়েছেন লেখক ও গবেষক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন।
তাঁরা দুজনই ছিলেন অবাঙালি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রধান কবি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক জয়দুল হোসেন মনে করেন,”বীরেরা কখনো মরেনা। তাদের কোনো দেশ নেই।এঁরা সকল দেশের, সকল মানুষের।”
দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তথা এই দুই বীর শহীদকে স্মরণীয় করে রাখতে শহরের নিমতলায় ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার উদ্যোগে এই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। এর উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন জি ও সি মেজর জেনারেল ওমরাও খান। গ্রামটির নামকরণ করা হয় তোফায়েল নগর। আর সেখানকার বাজারের নাম রাখা হয় তোফায়েল বাজার। মেজর তোফায়েল মোহাম্মদ পান ‘নিশান-ই-হায়দার’ পদক (মরণোত্তর)। জমাদার আজম খান পান ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদক (মরণোত্তর)।
বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আরও কিছু সৈনিককে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
বিজয়নগর উপজেলাতেও আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ বিদ্যমান। আজ অনেকটাই অবহেলিত এই স্মৃতিস্তম্ভ দুটো। অথচ একদিন দেশপ্রেমিক দুই বীরের নামের আদ্যক্ষরে খচিত হয়েছে তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার প্রধান সড়কের নাম টি,এ রোড।
➤তথ্য ঋণ:
[১] “Rupture in South Asia” (PDF)। United Nations High Commission for Refugees। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জানুয়ারি ২০২১।
[২] Dr Crispin Bates (৩ মার্চ ২০১১)। “The Hidden Story of Partition and its Legacies”। BBC। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জানুয়ারি ২০২১।
[৩] ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ইতিকথা/এস এম শাহনূর
[৪] কথোপকথন:
✪ জয়দুল হোসেন
কবি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক।
✪ জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন
লোকজ সংস্কৃতির লেখক ও গবেষক।
সভাপতি-উদীচী,ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা।
✪ সোহেল রানা ভূঁইয়া
অনলাইন একটিভিস্ট ও সমাজকর্মী।
✪ আওয়ার কন্ঠ
লেখক: আন্তর্জাতিক কবি ও গবেষক।
Copyright © 2025 Daily Frontier News | Design & Developed By: ZamZam Graphics