Daily Frontier News
Daily Frontier News

শ্রীরামসি গণহত্যা মানব সভ্যতার এক কলঙ্কজনক অধ্যায়

 

এস.পি.সেবু

অসংখ্য নদী উপনদীর মিলিত স্রোতধারা যেমন মোহনায় একাকার হয়ে সৃষ্টি করে মহা সমুদ্রের তেমনি আমাদের মহান স্বাধীনতার লোহিত সাগরে মিলিত হয়েছে সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি গ্রামের শহীদদের রক্তধারা। বাংলা মায়ের নাম নাজানা লাখো শহীদের মাঝে অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলছে তাদের নাম। আজ ৩১ আগস্টের প্রাক্ষালে আমরা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি তাদের। শ্রীরামসি তথা সারা বাংলার স্বাধীনতা পিপাসু মানুষের স্মৃতির সরোবরে চির অম্লান থাকবে তাদের মহান আত্মদান।

৩১ আগস্ট ১৯৭১। শিউলি ঝরা শরতের মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য অনেকখানি উপরে উঠে তার উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বময়। অন্য যেকোন দিনের মতোই শ্রীরামসি গ্রামের মানুষ দিনের প্রারম্ভেই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত। সকাল ১০ টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন বাশারাতের নেতৃত্বে ৯ টি নৌকা বোঝাই করে প্রায় অর্ধ শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসর কয়েকজন রাজাকার এসে শ্রীরামসি বাজারে উপস্থিত হয়। তারা স্থানীয় হাইস্কুলে অবস্থান নিয়ে এলাকায় শান্তি কমিটি গঠন করবে বলে ঘোষণা করে। কয়েকজন রাজাকার বাজারে এসে সবার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে যে, এখানে যাতে কোন দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য শান্তি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রতারক রাজাকারেরা পাড়ায় পাড়ায় গিয়েও শান্তি কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করে এবং সকলকে অবিলম্বে শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়। অন্যথায় মেশিনগানের গুলিতে গ্রামের সকল মানুষকে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি প্রদান করে। আসন্ন বিপদ এড়ানোর জন্য এবং গণহত্যার হাত থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষার উদ্দেশ্যে বাজারে অবস্থানরত সরলপ্রাণ ব্যক্তিবর্গ সরল বিশ্বাসেই স্কুলে গিয়ে জড়ো হতে থাকেন। বিভিন্ন পেশার যেমন শিক্ষক, পোস্টমাস্টার, তহশীলদার, ইউপি সদস্য, ছাত্র-যুবক, দোকান কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সহ প্রায় দেড় থেকে দুই শতাধিক লোক স্কুলে এসে উপস্থিত হন। সবাই মিটিং শুরু হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। এমন সময় হবিবপুরের রাজাকার লীডার আহমদ আলী খান সেনাধিনায়কের সাথে ফিসফিসিয়ে কি যেন আলাপ করলো এবং সাথে সাথেই হানাদার বাহিনীর ১০/১২ জন সৈন্য স্টেনগান হাতে স্কুলের চারপাশে অবস্থান নেয়। অন্য কয়েকজন অস্ত্র তাক করে থাকে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের দিকে। এক পর্যায়ে সকলকে অবাক করে দিয়ে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ফেলা হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। একে অপরের দিকে অসহায় চোখে তাকাতে থাকেন এবং আল্লাহকে ডাকতে থাকেন। বয়োবৃদ্ধ এবং মুরব্বী কয়েকজন ছাড়া বাকী সবাইকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দুই ভাগে বিভক্ত করে দাঁড় করানো হলো। ৫০/৬০ জনের প্রথম দলটিকে নৌকায় তুলে বাজারের দক্ষিনে অবস্থিত রহিম উল্লাহর পুকুর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো এবং ৬০/৭০ জনের অন্য দলটিকে নজির মিয়ার বাড়ির পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড় করানো হল। বাকী ২০/২৫ জন বয়োবৃদ্ধকে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করায় ছেড়ে দিতে রাজি হয়। যদিও রাজাকার আহমদ আলী এদেরকেও হত্যা করার জন্য তর্জন গর্জন করছিল।

এদিকে উভয় পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধ বন্দীদের কালেমা পড়ার নির্দেশ দেয়া হলে সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। নিশ্চিত মৃত্যু পথযাত্রীদের উচ্চস্বরে “আল্লাহু আকবার” ধ্বনির চিৎকারে সমগ্র শ্রীরামসি জনপদ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। এরই সাথে সাথে যোগ দেয় মেশিনগানের কান ফাঁটা সংহারী শব্দ। তারপর পিনপতন নিস্তবতা…। লুটিয়ে পড়লো পরষ্পর বন্ধনযুক্ত সারিবদ্ধ লাশ। গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে এলাকার অনেক সরলপ্রাণ মানুষের নিষ্প্রাণ নিথর দেহ।
হত্যাকাণ্ড শেষে পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকারেরা ফিরে এলো শ্রীরামসি বাজারে এবং ইচ্ছামাফিক লুটপাট চালালো। অবশেষে পেট্রোল ছিটিয়ে বাজারে আগুন ধরিয়ে দিল এবং তারা তিন দিনের কার্ফিউ জারী করে চলে যায়। গ্রামের আতংকিত ভয়ার্ত মানুষ ঐদিন রাতেই পৈতৃক ভিটেবাড়ী ত্যাগ করে অজানার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যায়। পরদিন কয়েকজন সৈন্য নিয়ে রাজাকাররা সদর্পে পুনরায় গ্রামে এসে উপস্থিত হয় এবং জনমানবহীন গ্রামের অনেক বাড়ী ঘরে আগুন ধরিয়ে ভষ্ম করে দেয়।

তিন দিনের কার্ফিউ থাকার কারণে গ্রামবাসী তাদের আত্মীয় স্বজনদের লাশ যথাসময়ে দাফন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে অধিকাংশ শহীদের লাশ শিয়াল কুকুরের খাবারে পরিণত হয়। দু’দিন পর এলাকার লোকজন বধ্যভূমিতে জড়ো হন, ততক্ষণে অধিকাংশ শহীদের লাশ পঁচে গলে বিকৃত হয়ে গেছে, অথবা শিয়াল কুকুর টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেছে। ফলে সবার লাশ শনাক্ত করা যায়নি। যে কয়েকজনের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিন, তহশিলদার এহিয়া চৌধুরী, সত্য নারায়ণ চক্রবর্তী, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, শফিকুর রহমান, ফিরোজ মিয়া, সুনু মিয়া, আলামিয়া, সমুজ মিয়া, নজির মিয়া, আব্দুল মান্নান, ওয়ারিছ মিয়া, মানিক মিয়া, আব্দুল জলিল, দবির মিয়া, মরম উল্লাহ্, মন্তাজ আলী, ছরওয়ার উল্লাহ্, আব্দুল মজিদ, আব্দুল লতিফ, এখলাস মিয়া, মোক্তার মিয়া, ছামির আলী, আব্দুল হাই, শামসু মিয়া, ছোয়াব উল্লাহ্, রুফু মিয়া, রুছমত আলী, আব্দুল হান্নান, আব্দুল বারিক মেম্বার, শুধাংশু টেইলার, শ্রীরামসি পোস্ট অফিসের জহির উদ্দিন প্রমুখ।

ঐদিনের বর্বরতার শিকার হয়েও মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বুলেটের রক্ততিলক ধারণ করে যারা বেঁচে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন গত সাড়ে চার দশকে তাদের অনেকেই আজ আমাদের মধ্যে নেই। আজো যারা আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে পঙ্গু অবস্থায় আমজাদ আলী, গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ছফিল উদ্দিন, হাজী আলকাছ মিয়া,জোয়াহির চৌধুরী, তপন চক্রবর্তী, হুশিয়ার আলী অন্যতম। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। বাঙ্গালী পেলো তাদের নিজস্ব আবাস ভূমি। পেলো সার্বভৌমত্বের প্রতীক লাল সবুজের বিজয় পতাকা।

স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনানী বঙ্গবীর এম এ জি ওসমানী শ্রীরামসির বধ্যভূমি পরিদর্শনে এলেন। এলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। শহীদানের স্মৃতি রক্ষার্থে অনেক

Daily Frontier News