ড. এস এম শাহনূর
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান কলি থেকে ফুল হতেই অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, “বঙ্গ মাগো তোমার আঁচলে আমি সোনার হরিণ জড়াবো।” বড় হয়ে ঠিক তাই করেছিলেন তিনি। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য শত অত্যাচার নির্যাতন ও জেল জুলুম সয়েছেন। কারাবরণ করতে হয়েছে বহুবার। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে রেসকোর্স ময়দানে (পরবর্তী সময়ে যার নাম হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে সংবর্ধনা সভায় তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে ঘোষণা দেন। সেই থেকে তিনি বাঙালির বঙ্গবন্ধু।
যুগে যুগে সারা পৃথিবীর স্বাধিকার আন্দোলনে কোনো একটি বা কয়েকটি নির্দিষ্ট স্লোগান সেই লড়াই-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই এই বাংলার পুরো জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা তথা তাদের স্বাধিকারের পথে নিয়ে যেতে একটি অভিন্ন স্লোগানের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের শেষে ‘জয় বাংলা’ বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে এটি পারমানবিক বোমার মত রণধ্বনি হিসাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। চাই মুক্তি,চাই স্বাধীনতা। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস একটি সশস্ত্র যুদ্ধ, ত্রিশলক্ষ তাজা প্রাণ,দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তানের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বাঙ্গালির কন্ঠ ছিল স্লোগানমুখর। উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী গণঅভুত্থ্যানে বাঙ্গালি ছাত্র ও সাধারণ মানুষের স্লোগান মুখর কণ্ঠে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হতে থাকে তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা‘, পিন্ডি না ঢাকা/ঢাকা ঢাকা, তুমি কে আমি কে/বাঙ্গালী বাঙ্গালী এ ধরনের স্লোগান। কিন্তু বাঙ্গালির রক্তে আগুন ধরানো মুক্তির স্লোগান তখনো প্রকাশিত হয়নি।
বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের উত্থানকে ঠেকাতে বাঙ্গালির মুক্তি সংগ্রামের সামনে থাকা সৈনিকদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ালেও তা বাঙ্গালিকে আরো জাগিয়ে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিণত করে জাতীয় বীরে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,বঙ্গবন্ধু,জয় বাংলা ও স্বাধীনতা শব্দ গুলো ওতোপ্রতভাবে ভাবে জড়িত। বাঙ্গালির ইতিহাস তো বটেই বাংলা ও বাঙ্গালির রাজনীতি ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম ম্লোগান বলা যায় এই জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ছাড়া জয় বাংলা যেমন অর্থহীন তেমনি জয় বাংল ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শব্দটি পূর্ণতা পায় না। অন্তত পক্ষে স্লোগানের ক্ষেত্রে।
স্বাধীনতার ঈঙ্গিতবাহী এক সামরিক রণধ্বনির নাম জয় বাংলা। জয় বাংলা ধ্বনি সৃষ্টির আগে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষাও মূর্ত হতে পারেনি। অর্থাৎ জয়বাংলার ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমানবয়সী। জয় বাংলা স্লোগান সৃষ্টির মধ্যদিয়ে বাঙালি তার আত্মপরিচয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক নির্মাণ করে।
বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা বিশ্বের মানবতার প্রতীক। তা আজ জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘Friends of the World’ বা বিশ্ববন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করে কূটনৈতিকরা। তাঁর ক্যারিসম্যাটিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ১৯৭৩ সালে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বিশ্ববন্ধু’ বলে সম্মান প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে বন্দী তখন কলকাতায় এক প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে কবি ও বুদ্ধিজীবী অন্নদাশঙ্কর রায় উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে উপস্থিতি না থাকতে পেরে রাতে বাড়িতে ফেরে লেখেন,
যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয়
হবে হবে জয়
জয় শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: ড. এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
Copyright © 2025 Daily Frontier News | Design & Developed By: ZamZam Graphics